Loading...

বিগত কয়েক দশকে নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে ইতিবাচক অনেক পরিবর্তন এসেছে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর থেকে নারীদের ক্ষমতায়নের জন্য অবিরাম প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। নারীরা এখন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, এবং সামাজিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজেদের দক্ষতার ছাপ রাখছেন। দেশের সংসদে নারীদের অংশগ্রহণ ও সক্রিয়তা এই অগ্রগতির একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক। নারীবান্ধব বিভিন্ন আইন ও নীতিমালা প্রণয়নের ফলে, নারীরা সমাজের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে বিশেষ করে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার অংশীদার হয়ে উঠছে। তবে নারীদের এই সাফল্যের প্রতিফলন পর্যালোচনা করার এখনই উপযুক্ত সময়। নারীর ক্ষমতায়নের বর্তমান চিত্র যেমন প্রশংসাযোগ্য তেমনি নারীরা প্রতিনিয়ত যে-সব বাধার সম্মুখীন হচ্ছে তা চিহ্নিত করা এবং এর প্রশমনে কাজ করতে সমষ্টিগত উদ্যোগ প্রয়োজন।

সাম্প্রতিক সময়ে, নারীদের শিক্ষা উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি এসেছে বাংলাদেশে। বাধ্যতামূলক বিনামূল্যে শিক্ষার সুযোগ নারীশিক্ষার হার উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়েছে। তাছাড়া, তুলনামুলকভাবে উচ্চশিক্ষায় কম খরচের ফলে নারীরা উচ্চশিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী হয়েছে। তবে, অগ্রগতি হলেও, প্রতিবন্ধকতাগুলো এখনও উল্লেখযোগ্য। শিক্ষা এখনও সকলের জন্য সমানভাবে সহজলভ্য নয়। অনেক পথশিশু, যারা সাধারণত সবচেয়ে বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে, তাদের শিক্ষা লাভের সুযোগ এখনও নেই, থাকলেও খুবই সীমিত। এর সাথে যোগ হয়েছে আমাদের সমাজে গেড়ে বসা রক্ষণশীল ও পিতৃতান্ত্রিক মনোভাব, যা এখনও অনেক পরিবার এবং সম্প্রদায়ের চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করে। এছাড়া, সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষায় জেন্ডার সমতা বৃদ্ধি করার উদ্যোগের পরও, জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা একটি বড় বাধা হিসেবে রয়ে গেছে। নারী শিক্ষার্থীরা রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমনকি যানবাহনে প্রায়ই হয়রানি, হুমকি ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়, যা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাদের নিয়মিত উপস্থিতিকে বাধাগ্রস্ত করে। বিশেষত, রক্ষণশীল পরিবারগুলো তাদের কন্যা সন্তানদের এই কারণে স্কুল বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাতে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে এবং দ্বিধাগ্রস্ত থাকে।

নারীর ক্ষমতায়নের পরবর্তী স্তর হলো, নারীদের সক্ষমতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নিরপেক্ষভাবে উপার্জনের সুযোগ প্রদান। গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে অর্থ উপার্জনকারী নারী কর্মীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশের রপ্তানি-ভিত্তিক তৈরি পোশাক (আরএমজি) শিল্পে ৫৩% কর্মী নারী, যারা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন। নারীরা এখন উদ্যোক্তা হিসেবে, সরকারি ও বেসরকারি চাকরিতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, এমনকি বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ও প্রকৌশলের ক্ষেত্রে কাজ করেও অর্থনৈতিক অবদান রাখছেন। সাম্প্রতিক সময়ে, বাংলাদেশ বিমানে ফ্লাইট অপারেশন্সের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পেয়ে বাংলাদেশের বিমান চলাচল ইতিহাসে প্রথম নারী হিসেবে যোগদান করেছেন মিস তাসনিম দোজা। ২০২৪ সালে দ্বিতীয়বারের মতো বাংলাদেশ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ ধরে রেখেছে। যদিও এসব সফলতা প্রশংসনীয় ও উল্লেখযোগ্য, তবে নারীদের কর্মসংস্থানের পরিস্থিতি বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন। নিয়োগ প্রক্রিয়া অনেক সময় পক্ষপাতদুষ্ট, পিতৃতান্ত্রিক এবং এমনভাবে গঠিত যে, নারীদের নেতৃত্বের পদে আসীন হওয়ার সুযোগ কম। সাফ ফুটবল দলের মেয়েরা আমাদের আশার প্রদীপ হলেও, তাদের গত দুই মাসের বেতন প্রদান করা হয়নি। নারী ফুটবল খেলোয়াড়দের স্থানীয়রা স্কার্ট পরার কারণে আক্রমণ করেছে, তাদের ছেলেদের মতো খেলতে দেখে তাচ্ছিল্য করেছে এবং আমাদের রক্ষণশীল সমাজ তাদের নীচু দৃষ্টিতে দেখার সুযোগ পাচ্ছে এসব কারণে। আমাদের বুঝতে হবে, যখন নারীরা পুরুষদের মতো সমানভাবে সক্ষম এবং শিক্ষিত, তখন নারীদের জন্য টেকসই শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য সমান ও নিরপেক্ষ চাকরির সুযোগের ব্যবস্থা করা উচিত। আমাদের দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এখনো উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত নারীদের পারিবারিক দায়িত্বে সীমাবদ্ধ করে রাখা হয়। এছাড়াও কর্মস্থলে যৌন হয়রানি ও জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতার ঘটনা নারীদের উপার্জনের সুযোগকে বাধাগ্রস্ত করছে। নারীর নিজের উপার্জনের উপর আর্থিক নিয়ন্ত্রণ না থাকা নারীর ক্ষমতায়নের পথে আরেকটি বড় প্রতিবন্ধকতা। 

নারীদের স্বাস্থ্য অধিকার নিশ্চিত করা নারীর ক্ষমতায়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দরিদ্রতা সত্ত্বেও, বাংলাদেশ নারী ও শিশুর স্বাস্থ্য উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। ১৯৮০ সালের মাঝামাঝি থেকে মাতৃমৃত্যু হার এক তৃতীয়াংশ কমেছে, এবং গত দশকে শিশু মৃত্যুহার অর্ধেক হয়ে গেছে। উন্নত জীবনকাল, টিকাদান কার্যক্রম, এবং যক্ষ্মা ও ডায়রিয়া নিয়ন্ত্রণ এই সফলতার অংশ হিসেবে রয়েছে। তবে, বাংলাদেশ এখনও এর সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা প্রদান লক্ষ্য থেকে অনেক দূরে। বাংলাদেশ ২০৩২ সালের মধ্যে সকল নাগরিক এবং সম্প্রদায়কে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সেবা প্রদান করার লক্ষ্যে কাজ করছে, যাতে নাগরিকরা সাশ্রয়ী মূল্যে চিকিৎসাসেবা পেতে পারে। নারীদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করা এখনও বেশ কঠিন, কারণ অনেক সেবা প্রদানকারী ক্লিনিক বা হাসপাতাল তাদের বাসস্থান থেকে বেশ দূরে অবস্থিত, যা তাদের সময়মতো চিকিৎসা পাওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করে। বিশেষ করে গ্রামীণ নারীদের অনেক সময় পরিবারের পুরুষ সদস্যদের উপর নির্ভর করতে হয় কাছাকাছি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য, যা চিকিৎসা নিতে দেরি হওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং এতে রোগীর অবস্থা আরও খারাপ হয়। এছাড়া, রক্ষণশীল পরিবারের সদস্যরা এখনও আধুনিক চিকিৎসা সাহায্যের চেয়ে প্রথাগত ওষুধকেই বেশি গুরুত্ব দেন। এবং যখন তারা আধুনিক চিকিৎসা নেন, তখন নারীরা পুরুষ চিকিৎসকদের পরিবর্তে সাধারণত নারী চিকিৎসককেই বেছে নেন শুধু তাদের রক্ষণশীলতার কারণে। যৌন এবং প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার এখনো আমাদের সমাজে একটি গোপনীয় বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়, এবং অনেকেই এই বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করতে অথবা এর সমাধান গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয়। এই সামাজিক রীতির কারণে, বিশেষ করে কিশোরী মেয়েরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্যের অভাব, সঠিক শিক্ষা না থাকা, এবং পরিবারের কিংবা সমাজের পক্ষ থেকে এই বিষয়ে আলোচনা না হওয়া কিশোরীদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায়। অনেক কিশোরী তাদের শারীরিক পরিবর্তন, গর্ভধারণ, বা যৌন স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে সঠিক সাহায্য বা পরামর্শ পায় না, যার ফলে তারা অজ্ঞতার কারণে নানা স্বাস্থ্যঝুঁকির শিকার হয়। 

নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার জন্য পর্যাপ্ত আইন এবং তাদের সঠিক বাস্তবায়ন এখনও বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। যদিও দেশে নারীদের সুরক্ষার জন্য বেশ কিছু আইন এবং নীতি রয়েছে, তবুও এসব আইনের যথাযথ প্রয়োগে অনেক ফাঁকফোকর রয়ে গেছে। আইন থাকা সত্ত্বেও, সঠিক প্রয়োগের অভাব, পুলিশের উদাসীনতা, এবং বিচারিক প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রিতা নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বাধা সৃষ্টি করছে। অনেক সময় নারীরা আইনি সুরক্ষা পাওয়ার পরেও সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিবন্ধকতার কারণে আইনানুগ বিচার পায় না, যার ফলে তারা ন্যায়বিচারের আশা হারিয়ে ফেলে। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে আইন ও তাদের বাস্তবায়ন ব্যবস্থার মধ্যে বড় ধরনের সংস্কারের প্রয়োজন।

বাংলাদেশ নারীর ক্ষমতায়নের পথে একটি চিত্তাকর্ষক যাত্রা করেছে, কিন্তু এই যাত্রা এখনও পূর্ণাঙ্গ হয়নি। সরকার, সুশীল সমাজ, এবং সকল স্তরের ব্যক্তিদের উচিত এমন একটি ভবিষ্যতের দিকে কাজ করা যেখানে প্রতিটি নারী মর্যাদা, সমতা এবং ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠতে পারে। নারীর যথাযথ ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে একইসাথে রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, পারিবারিক এবং ব্যক্তিকেন্দ্রিক উদ্যোগ প্রয়োজন। আমাদের সমাজে যে পুরুষতান্ত্রিক নিয়মগুলো কাজ করছে, সেগুলোর বিরুদ্ধে সচেতনতা এবং সামাজিক পরিবর্তন প্রয়োজন। পূর্ণ জেন্ডার সমতা অর্জনের প্রক্রিয়া একটি জটিল এবং চলমান যাত্রা, যেখানে প্রতিটি নারীকে তাদের সম্ভাবনা পূর্ণরূপে উপলব্ধি করার সুযোগ দিতে হবে। নতুন বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য এই অগ্রগতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে, যেন নারীরা সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে অবদান রাখতে সক্ষম হন।


লেখক পরিচিতি: 

ফারাহ্ কবির,

কান্ট্রি ডিরেক্টর, একশনএইড বাংলাদেশ

মোবাইল নাম্বার: +8801711883796 

মেইল: farah.kabir@actionaid.org