জলবায়ু-সহনশীল অর্থনীতি এখন সারা পৃথিবীতে অগ্রাধিকার। তাই অর্থনীতিতে জলবায়ু-সহনশীল রূপান্তরের ক্ষেত্রে বাজেট নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। বাজেটে প্রণয়নের ক্ষেত্রে সরকারি বরাদ্দ যেমন গুরুত্বপূর্ণ, একই সঙ্গে প্রয়োজন সহায়ক নীতি ও কাঠামো গড়ে তোলা। সেই বিবেচনায় সরকারের জায়গা থেকে জলবায়ু পরিবর্তনসংশ্লিষ্ট বিষয় এবারের বাজেটে কতটুকু অগ্রাধিকার পেল, তা একটি প্রধান প্রশ্ন। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় ইতিমধ্যে বেশ কিছু নীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। অভিযোজন বিবেচনায় ২০২৩ থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের জন্য সরকার জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা (ন্যাপ) প্রণয়ন করেছে, যাতে ১১৩টি কর্মসূচি চিহ্নিত করা হয়েছে। হিসাব মতে, এই নীতিমালা বাস্তবায়নের জন্য ২৩০ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। অন্যদিকে সরকারি সূত্রমতে অভিযোজনের জন্য এখন সরকার প্রতি বছর ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলায় ব্যয় করছে, যদিও অভিযোজনের জন্য প্রতিবছর ৯ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন। এ ছাড়া কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনা সম্পর্কিত পরিকল্পনা (এনডিসি) বাস্তবায়নে ১৭৫ কোটি ডলার প্রয়োজন। পাশাপাশি সম্প্রতি এক কর্মসূচিতে পরিবেশমন্ত্রী উল্লেখ করেছেন, মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা (এমসিপিপি) এবং বাংলাদেশ ডেল্টাপ্ল্যান ২১০০-এর জন্য চিহ্নিত অগ্রাধিকার প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের জন্য ৪৭১ দশমিক ৭২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রয়োজন। এবারের বাজেটে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে অভিযোজনের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং প্রভাব হ্রাস-সংক্রান্ত কার্যক্রমকে আরও বেগবান করার লক্ষ্যে ১০০ কোটি টাকার বিশেষ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। সহজেই বোঝা যায়, প্রয়োজনের তুলনায় এই বরাদ্দ কতটা কম।
সরকার সাধারণভাবে জলবায়ু-সংশ্লিষ্ট ২৫টি মন্ত্রণালয়/বিভাগে জলবায়ু-সংক্রান্ত বাজেটে বরাদ্দ দিয়ে থাকে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই বরাদ্দের পরিমাণ ছিল প্রায় ৩৭ হাজার ৫২ কোটি টাকা। খাতওয়ারি বরাদ্দ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে উন্নয়ন বাজেটে পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ খাতে বাজেটের ৩ দশমিক ৯ শতাংশ বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে। অন্যদিকে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ১ হাজার ৬৩৮ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দ প্রস্তাব হয়েছে ২ হাজার ৭১ কোটি টাকা, যা বরাদ্দের তুলনায় ৪৩৩ কোটি টাকা বেশি, যার মধ্যে উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ ১ হাজার ৩০৯ কোটি টাকা। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় এটি একটি ইতিবাচক দিক। তবে ২০২৩-২৪ সংশোধিত বাজেটের তুলনায় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের ২০২৪-২৫ প্রস্তাবিত বরাদ্দ বৃদ্ধি সামান্য, এই অর্থবছরে বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে ২ হাজার ১৩১ কোটি টাকা, যা সংশোধিত বাজেট থেকে মাত্র ৬০ কোটি টাকা বেশি। এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে ১ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা, গত অর্থবছরের থেকে মাত্র ৯৪ কোটি টাকা বেশি।
জলবায়ু প্রভাব মোকাবিলায় তহবিলের সংস্থান এই মুহূর্তে একটি আলোচিত বিষয়। একদিকে দুর্যোগ মোকাবিলা এবং অন্যদিকে মানুষের জীবন ও জীবিকার নিশ্চয়তা বিধানে ধারাবাহিক বিনিয়োগ করা দরকার। ২০২৩-২৪ অর্থবছর ও এবারের বাজেট বক্তৃতায় বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড অ্যাকশনপ্ল্যানের (বিসিসিএসএপি) বাস্তবায়নের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এই কৌশলগত পরিকল্পনায় ছয়টি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি অগ্রাধিকার উল্লেখ করা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে খাদ্যনিরাপত্তা, সামাজিক নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য, সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামো, গবেষণা ও জ্ঞান ব্যবস্থাপনা, কার্বন নিঃসরণ কমানো ও নিম্ন-কার্বন উন্নয়ন, দক্ষতা উন্নয়ন ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি ইত্যাদি।
কৃষিতে অভিযোজন এবং জলবায়ু মোকাবিলার সক্ষমতা বৃদ্ধিতে ধারাবাহিক বিনিয়োগ বাংলাদেশের বাস্তবতার ভিত্তিতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার। আজকের বাংলাদেশের এক বিস্তৃত অঞ্চল লবণাক্ততার প্রভাবে বছরের বেশিরভাগ সময় অনাবাদি পড়ে থাকে। এ অঞ্চলের জন্য লবণসহিষ্ণু জাত উদ্ভাবনে ধারাবাহিক গবেষণা দরকার, তবে শুধু জাত উদ্ভাবন সমস্যার সমাধান করতে পারবে না, কৃষির জন্য সহায়ক স্থানীয় পরিবেশ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও বিনিয়োগ অব্যাহত রাখতে হবে। পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ের পরিপ্রেক্ষিতে ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর নেতৃত্বে অভিযোজন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিশেষ বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন।
অন্যদিকে শুল্কায়ন বিবেচনায়, এবারের (২০২৪-২৫) বাজেট এলইডি ও এনার্জি সেভিং ল্যাম্প উৎপাদনের উপকরণ আমদানিতে শুল্ক শূন্য শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে, যা এ ধরনের পণ্যগুলোর দাম বৃদ্ধি করবে এবং বিদ্যুৎসাশ্রয়ী নীতির পরিপন্থী হবে। একই নীতিকাঠামো অনুসরণ করা হয়েছে সিএনজি কনভার্সন কিট, সিলিন্ডার ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি আমদানির ক্ষেত্রে, যেখানে আমদানি শুল্ক ৩ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশের প্রস্তাব করা হয়েছে। এই দুই ক্ষেত্রই সরকারের কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনা এবং এই লক্ষ্যে প্রণীত এনডিসি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হতে পারে। তবে এবারের বাজেটে জীবাশ্ম জ্বালানিকেন্দ্রিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর যন্ত্রাংশ আমদানি শুল্ক শূন্য থেকে ৫ শতাংশে বৃদ্ধি করা হয়েছে, যা হয়তো জীবাশ্ম জ্বালানিকেন্দ্রিক বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ কিছুটা বাড়াবে, তবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎসাহিত করতে বাজেটে প্রণোদনাব্যবস্থা রাখা দরকার, যাতে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা এ ক্ষেত্রে উৎসাহিত হন। বাজেটে পরিবেশ সংরক্ষণে পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা-২০২৩ ও বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা-২০২২ বাস্তবায়ন, পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ বা কমিয়ে আনতে সুনির্দিষ্ট বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন।
এবারের বাজেটে সরকারের পক্ষ থেকে বিসিসিএসএপির পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা বাংলাদেশ ডেল্টাপ্ল্যান, বাংলাদেশ ক্লাইমেট ফিসক্যাল ফ্রেমওয়ার্ক, বাংলাদেশ ক্লাইমেট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট প্ল্যাটফর্ম গঠন, দুর্যোগের ঝুঁকি মোকাবিলায় ডিজাস্টার রিস্ক ফাইন্যান্সিং স্ট্র্যাটেজি প্রণয়ন করা কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় জলবায়ু সহনশীল ও সবুজ অগ্রাধিকারমূলক স্থানীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন, অর্থায়ন ও বাস্তবায়নের জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদানসহ অনেক প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল; কিন্তু আদতে সেসব প্রতিশ্রুতির কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে, তা এখন প্রশ্নসাপেক্ষ।
লেখক : উন্নয়নকর্মী ও কলামিস্ট
psmiraz@yahoo.com