Loading...

Published Date: Jun 05, 2024

জেন্ডার বাজেট: এবার সুষ্ঠু বণ্টনের রূপরেখা মিলবে কি?

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সরকার গঠনের পর এই মেয়াদে আগামী ৬ জুন প্রথমবার বাজেট প্রস্তাব উঠছে সংসদে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা আর মূল্যস্থিফিতির এই সংকটে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের এই বাজেট বাড়তি মনোযোগ পাচ্ছে। ইতোমধ্যে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ আকারের বাজেট উত্থাপন করা হচ্ছে। এবার বিশেষ সতর্ক দিয়ে বলা হচ্ছে- ‘সরকারের এবারের বাজেট হবে ব্যয় সংকোচমূলক। এটি তৈরি হচ্ছে অত্যন্ত সুকৌশলে।’ তাহলে ধরে নেয়া যায়, কোন খাতে বাজেটের কী পরিমাণ বরাদ্দ থাকবে এবং তা কীভাবে বণ্টন ও বাস্তবায়ন হবে সেটাও অত্যন্ত  সুপরিকল্পিতভাবে তৈরি করা হচ্ছে। এই হিসেবে বলা যায়, জেন্ডার বাজেটেও সুষ্ঠু পরিকল্পনার ছাপ দেখতে পাবো বলে আপাতত আশা রাখতে পারি। তবে অতীত অভিজ্ঞতা থেকে প্রশ্ন আসে- এবারের জেন্ডার বাজেটে সুষ্ঠু বণ্টন ও বাস্তবায়নের রূপরেখা মিলবে কি? 

২০২৩-২৪ অর্থবছরে জেন্ডার বাজেটে আড়াই লাখ কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ৪৪টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এই টাকা খরচ করেছে। গত দেড় দশকের চিত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, টাকার অঙ্কে নারীর উন্নয়নে বা জেন্ডার বাজেট প্রায় ১০ গুণ বেড়েছে। তবে বাজেটের এক-তৃতীয়াংশ খরচ হয় নারীর উন্নয়নে। বাকি বিপুল অঙ্কের এই টাকার পুরোটাই নারীর উন্নয়নে খরচ হয়েছে কি না তা নিয়ে ধোঁয়াশা থেকে গেছে। বাজেট বরাদ্দ ও বণ্টনের ক্ষেত্রে সঠিক রূপরেখা মেলেনি। 

শুধু তাই নয়, জেন্ডার বাজেট খরচের পর কোথায় নারী ক্ষমতায়নে কতটুকু উন্নতি হলো এবং পরবর্তীতে কী করা হবে তা নিয়ে কোনও পর্যালোচনা দেখা যায়নি। নারীর ক্ষমতায়ন ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি কীভাবে বাড়ল; উৎপাদন, শ্রমবাজার ও আয়বর্ধক কাজে নারীর অধিক অংশগ্রহণ কতটুকু নিশ্চিত হলো এবং সরকারি সেবা প্রাপ্তিতে নারীর সুযোগ বৃদ্ধির কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে তারও কোন সুষ্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।  

জেন্ডার বাজেট যেখানে পুরো বাজেটের ৩৪ শতাংশ ছিল, নারী-পুরুষের মধ্যে সমতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাজেটের বাস্তবায়নে যথাযথ পদক্ষেপের অভাব চিহ্নিত করেছেন বিশ্লেষকরা। এ বছরের জেন্ডার বাজেট প্রতিবেদনে কিছু খাতের বরাদ্দকে নারীর উন্নয়ন হিসেবে দেখিয়েছে যা অদ্ভুত মনে হয়েছে। যেমন নারী ভোটারের ডেটাবেজ তৈরি, মিরপুর ও মালিবাগে সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য অবকাঠামো তৈরি এবং গ্যাস উত্তোলন বাড়ানোর বরাদ্দকেও পর্যন্ত জেন্ডার বাজেটে দেখানো হয়েছে।   

এদিকে চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) তথ্য ঘেটে দেখা যায়- মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়-এর নেওয়া ১৪টি প্রকল্পের মধ্যে মাত্র ২টি প্রকল্প সরাসরি নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের সাথে সম্পৃক্ত। তাই প্রশ্ন জাগে- নারীর উন্নয়ন কি শুধু উন্নয়ন-কর্মশালা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ? নাকি এটি নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা, বাল্যবিবাহ রোধের মতো কার্যক্রমের ক্ষেত্রে সমান বরাদ্দ? এই জায়গায় স্বচ্ছতা থাকা প্রয়োজন। প্রান্তিক এলাকাতেও যখন নারী উন্নয়নে সমবণ্টন থাকবে তখন নারীর প্রতি সহিংসতাসহ জেন্ডারভিত্তিক সমস্যাসমূহ থাকবে না। 

সম্প্রতি জেন্ডার ভিত্তিক সহিংসতার শিকার এমন ৪ হাজার জনের (নারী, কিশোরী ও ট্রান্স জেন্ডার) মধ্যে এক সমীক্ষা পরিচালনা করেছে একশনএইড বাংলাদেশ। সেখানে দেখা গেছে, এদের মধ্যে ৭২ শতাংশ সহিংসতা শিকার হয়েছেন ১৫-২৯ বছর বয়সিরা।  

বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে এবং ইউএনএফপিএ-এর কারিগরি সহযোগিতায় ‘হেল্থ অ্যান্ড জেন্ডার সাপোর্ট প্রজেক্ট (এইচজিএসপি)’ ২০২১ সাল থেকে কাজ করছে একশনএইড বাংলাদেশ। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সার্বিক তত্ত্বাবধানে  কক্সবাজার ২৫০ বেড সদর হাসপাতালে্র ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার এবং উখিয়া, কুতুবদিয়া, মহেশখালী ও টেকনাফ ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেলে জেন্ডার ভিত্তিক সহিংসতার শিকার ভুক্তভোগীদের সেবা শক্তিশালীকরণ এবং বিভিন্ন সেবা প্রদানকারীদের মধ্যকার সংযোগ বৃদ্ধিতে সক্রীয় ভূমিকা পালন করছে একশনএইড বাংলাদেশ।

জেন্ডার বাজেটের উপযুক্ত ব্যবহারের ক্ষেত্রগুলোকে আরও নির্দিষ্ট করা যেতে পারে। আইনের আশ্রয়প্রার্থী নারীর খরচ, সহিংসতার শিকার নারীদের সহায়তা প্রদান, জেন্ডার সহিংসতা রোধে সার্বিক পরিকল্পনা ও কার্যক্রম গ্রহণ, সন্তান লালন-পালনে সহায়তা প্রদান এবং বাল্যবিবাহ বন্ধে কিশোরীর পড়াশোনার ব্যয়ের মতো বিষয়গুলো জেন্ডার বাজেটের পরিকল্পনায় আওতাভুক্ত করা যেতে পারে।

দেশে নারীর ক্ষমতায়নে সামগ্রিক চিত্রের অগ্রগতি হলেও অর্থনৈতিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্যহারে এখনও অনেক নারী পিছিয়ে আছেন। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) এর প্রতিবেদন অনুযায়ী লিঙ্গসমতা অর্জন করতে বাংলাদেশকে অপেক্ষা করতে হতে পারে প্রায় ২০০ বছর। যেখানে বিশ্বের সময় লাগতে পারে ১৩২ বছর। জাতিসংঘের হিসাব অনুসারে- এই বৈষম্য দূর করতে হলে নারী উন্নয়নে বছরে বৈশ্বিকভাবে ৩৬০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে। বিশ্বের তুলনায় দেশে নারীর অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি মন্থর। নারী উন্নয়নে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বরাদ্দ ধরা হয়েছে আড়াই লাখ কোটি টাকা যা বাজেটের ৩৪ শতাংশেরও বেশি। ন্যায্যতার ভিত্তিতে বরাদ্দ অর্থের কার্যকরী বিনিয়োগ ও সুষ্ঠু ও বণ্টন নিশ্চিত করা, এবং ভবিষ্যতে সকলকে সাথে নিয়ে দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্য কমিয়ে আনতে বাজেট ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে। 

দেশে নারীর ক্ষমতায়নে সামগ্রিক চিত্রের অগ্রগতি হলেও অর্থনৈতিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্যহারে এখনও অনেক নারী পিছিয়ে আছেন । বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) এর প্রতিবেদন অনুযায়ী জেন্ডার সমতা অর্জন করতে বাংলাদেশকে অপেক্ষা করতে হতে পারে প্রায় ২০০ বছর। যেখানে বিশ্বের সময় লাগতে পারে ১৩২ বছর। জাতিসংঘের হিসাব অনুসারে- এই বৈষম্য দূর করতে হলে নারী উন্নয়নে বছরে বৈশ্বিকভাবে ৩৬০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে। বিশ্বের তুলনায় দেশে নারীর অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি মন্থর। নারী উন্নয়নে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বরাদ্দ ধরা হয়েছে আড়াই লাখ কোটি টাকা যা বাজেটের ৩৪ শতাংশেরও বেশি। ন্যায্যতার ভিত্তিতে বরাদ্দ অর্থের কার্যকরী বিনিয়োগ ও সুষ্ঠু ও বণ্টন নিশ্চিত করা, এবং ভবিষ্যতে সকলকে সাথে নিয়ে দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে জেন্ডার বৈষম্য কমিয়ে আনতে বাজেট ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে। 

এছাড়া, আইনি অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের নারীরা দক্ষিণ এশিয়ার বেশিরভাগ দেশের থেকে পিছিয়ে। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে- কর্মক্ষেত্রে দেশের নারীরা পুরুষের তিন ভাগের এক ভাগ মাত্র আইনি অধিকার ভোগ করেন। নারীদের পারিশ্রমিকহীন সেবাকাজে সম্মানী দেওয়া হলে তার পরিমাণ বৈশ্বিক জিডিপির ৪০ শতাংশের মতো হতো। অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে এসব বৈষম্য দূরীকরণে প্রয়োজন সঠিক খাতে যথাযোগ্য বিনিয়োগ। মূলত, সামাজিক ক্ষমতায়ন, অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন, সরকারি পরিষেবা প্রাপ্তি এবং ন্যায়বিচার প্রাপ্তি এই চারটি জায়গায় বিনিয়োগে প্রাধান্য দেওয়া প্রয়োজন।

ধারাবাহিক নারী আন্দোলনের ফসল হলো জেন্ডার বাজেট। এই বাজেট শুধু নারীর জন্য আলাদা কোনো বাজেট নয়, বরং এটি এমন একটি পদ্ধতি, যার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় হিসাব-নিকাশের সাহায্যে জাতীয় বাজেটের জেন্ডার-সংবেদনশীলতা বিশ্লেষণ করা যায়। এই বাজেটের যথাযথ বরাদ্দ ও সুষ্ঠু বণ্টনের মাধ্যমে পুরো দেশের জাতীয় অর্থনৈতিক প্রগতি নিশ্চিত হবে। এবারের বাজেটে অসঙ্গতিগুলো চিহ্নিত করে সুপরিকল্পিত বরাদ্দ, বণ্টন ও বাস্তবায়নের রূপরেখা দেখতে পাবো বলে প্রত্যাশা থাকবে। 


লেখক পরিচিতি:

ফারাহ্ কবির,

কান্ট্রি ডিরেক্টর, একশনএইড বাংলাদেশ