Loading...

Published Date: May 05, 2024

সুপেয় পানির অভাবে উপকূলবাসী

গ্রীষ্মের দাবদাহ মানুষের অস্বস্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে বাড়িয়ে দিচ্ছে। এই তাপপ্রবাহ একদিকে শ্রমজীবী মানুষদের জীবন ও জীবিকা দুর্বিষহ করে তুলছে এবং অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবকে বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে। গ্রীষ্মে তাপপ্রবাহ আমাদের আবহাওয়ায় অস্বাভাবিক নয়, তবে এবার এর মাত্রা অনেক বেশি। বেশ কয়েকটি বিষয় এই তাপপ্রবাহকেই যেন অস্বাভাবিক করে তুলছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পরিবেশের উষ্ণায়ন তাপমাত্রা বৃদ্ধি অন্যতম কারণ, পাশাপাশি এলনিনোর প্রভাবে এবারের গরম বেশি। এসবের প্রভাবেই এবার এপ্রিলে আমাদের দেশে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ স্বাভাবিকের তুলনায় কম। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যে উপসাগরীয় অঞ্চলের বৃষ্টিপাত নজিরবিহীন বন্যা ঘটাচ্ছে। তবে এ সময়ের আমাদের দেশে অস্বস্তিকর তাপপ্রবাহের পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে, প্রাকৃতিক পরিবেশের বিপর্যয় ও নির্বিচারে বৃক্ষনিধন। বিশেষজ্ঞরা বলেন, ঢাকার তাপপ্রবাহের অন্যতম কারণ সবুজায়নের অভাব, অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও বায়ুমণ্ডলে মিথেন গ্যাসের অতিরিক্ত উপস্থিতি।

শহরের মানুষের তাপপ্রবাহের অভিজ্ঞতা আমরা জানতে পারি মিডিয়া ও সংবাদমাধ্যমের মাধ্যমে। ঠিক তেমনটি খবরে আসে না গ্রামীণ জনপদের দুর্ভোগ। গরমের অস্বস্তি তো আছেই। তবে এর চেয়ে অনেক বেশি সংকট তৈরি হয় জীবন-জীবিকায়, বিশেষ করে সুপেয় পানীয় জলের সংস্থানের ক্ষেত্রে। এই দুর্ভোগ শুধু এ বছরের দীর্ঘ তাপপ্রবাহের কারণেই নয়। প্রতি বছরই ঘুরে ঘরে আসে। তবে দেশের সব প্রান্তের চিত্র একই ধরনের না। বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলে শুষ্ক মৌসুমে সুপেয় পানির সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করে। শুষ্ক মৌসুম শুরুর পর থেকেই এই সুপেয় জলের সংকট বাড়তে থাকে এবং বর্ষা মৌসুমের আগে ধীরে ধীরে চূড়ান্ত আকার ধারণ করে। এ সময়ে বৃষ্টির অভাবে পুকুর, খাল ও বিল সব শুকিয়ে কাঠ। উপরন্তু উপকূলীয় অঞ্চলে ভূ-স্তরজনিত কারণে বেশ কিছু এলাকায় নলকূপ স্থাপন করা যায় না। ফলে তাদের বিপর্যস্ত অবস্থা সহজেই অনুমেয়। এই অবস্থায় একদিকে আশপাশে মিষ্টি পানির উৎস শুকিয়ে যাওয়া, অন্যদিকে এ সময় নদী ও খালের পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যায়। ফলে খাবার পানি সংগ্রহে একটি বড় সমস্যা তৈরি হয়। পানি ফুটিয়ে জীবানুমুক্ত করার তত্ত্ব এখানে কাজ করে না। তারপরও এসব সমস্যা মোকাবিলার জন্য স্থানীয় পর্যায়ে বেশ কিছু উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন মাধ্যমে খাবার পানিকেন্দ্রিক এক ধরনের ব্যবসায়িক সরবরাহ ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। ফলে একটি দরিদ্র পরিবারকে সুপেয় পানি সংগ্রহে মাসিক খরচের সঙ্গে আরও একটি বাড়তি খরচ যোগ করতে হয়। আবার যারা একেবারেই সামর্থ্যহীন তাদের এক কলস নিরাপদ পানির সংগ্রহে এই গরমে মাইলের পর মাইল হাঁটতে হয়।

নিরাপদ পানির স্বল্পতা শুধু দরিদ্র পরিবারগুলোর ওপর অর্থনৈতিক চাপ তৈরি করে না। এমন অবস্থা দরিদ্র পরিবারগুলোর ওপর নানা ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে, যা তাদের ওপর অর্থনৈতিক চাপ দ্বিগুণ করে দেয়। উপকূলীয় অঞ্চলে এই সময়গুলোতে পানীয়-জলের অভাব স্বল্প আয়ের পরিবারগুলোতে দরিদ্রতার জাল ছিন্ন করার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধক। অন্যদিকে পানির সংকট নারী ও কিশোরীদের ওপর ভিন্ন প্রভাব ফেলে। এদের অনেককে দূরবর্তী অবস্থান থেকে পানি সংগ্রহের জন্য বেশি সময় ব্যয় করতে হয়, যা শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করে। বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে, উপকূলীয় অঞ্চলে লবণ পানির প্রভাবে নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্য মারাত্মক ঝুঁকির সম্মুখীন। নিরাপদ পানির অভাবে অনেক নারী তার মাসিক ঋতুচক্রকে কৃত্রিমভাবে বন্ধ করার জন্য জন্মনিয়ন্ত্রণের ওষুধ পর্যন্ত ব্যবহার করে, যাদের মধ্যে কিশোরীরাও আছে। এ ধরনের পরিস্থিতি তাদের প্রজনন স্বাস্থ্যসহ শরীরের স্থায়ী ক্ষতিসাধন করে।

উপকূলীয় অঞ্চলে পানীয় জলের সমস্যা সমাধানে সরকার ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে অসচ্ছল পরিবারগুলোকে পানির ট্যাঙ্কি সরবরাহ করা। মূলত বৃষ্টির পানি ধরে রেখে ব্যবহার করার জন্য এই ব্যবস্থা। স্বাভাবিকভাবেই এসব পানির পাত্র গ্রীষ্মে কাজ করে না। অন্যদিকে উপকূলীয় অঞ্চলে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সুপেয় পানি সরবরাহের জন্য বহুল ব্যবহৃত পন্ড স্যান্ড ফিল্টার (পিএসএফ)-এর ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু একদিকে পানির উৎস কমে যাওয়া ও দীর্ঘদিন অব্যবস্থাপনার ফলে এসব ফিল্টার এক সময় ঠিকভাবে কাজ করে না। অনেক সময় এসব ফিল্টার থেকে সবসময় পানি পাওয়া যায় না, আবার পানির গুণগতমানও ঠিক থাকে না। যার মূল কারণ ধরেই নেওয়া হয়, এসব স্থাপনার ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকবে স্থানীয় কমিউনিটি। যেখানে শহর অঞ্চলে পানীয় জল সরবরাহের দায়িত্বে থাকে সরকারি বিভিন্ন সংস্থা, সেখানে প্রান্তিক পর্যায়ে এর দায়িত্ব দেওয়া হয় কমিউনিটির ওপর! তাও আগে এসব অঞ্চলে সুপেয় পানি সরবরাহের জন্য বেশ কিছু খাস পুকুর ছিল, গ্রামবাসী এই পুকুরগুলো সংরক্ষণ করত। কিন্তু এসব পুকুরের অধিকাংশই বেদখল বা ভরাট হয়ে গেছে। 

আবহাওয়াবিদরা বলছেন, এবারের গ্রীষ্মকাল দীর্ঘায়িত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আবার অতিরিক্ত গরমে বেশি বৃষ্টিপাতও হতে পারে। বৃষ্টিপাত শুরু হলে এ ধরনের পানির সংকট হয়তো এ বছরের মতো কমিয়ে দেবে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, এমন সংকট আগামী বছরে পুনরাবৃত্তি হবে না। মূলত দীর্ঘদিন ধরেই উপকূলীয় জনগোষ্ঠী এই সংকটের ভুক্তভোগী।

উপকূলীয় অঞ্চলে সুপেয় পানির সমস্যা দূর করার জন্য এখনই পরিকল্পনা গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন  দরকার। এটিই হতে পারে বাংলাদেশের অনেক মেগা প্রকল্পের মধ্যে উপকূলবাসীর জন্য একটি কাক্সিক্ষত মেগা প্রকল্প। সে ক্ষেত্রে উপকূলীয় অঞ্চলে নিরাপদ পানির সরবরাহের জন্য সুপেয় পানির উৎস বাড়ানো দরকার। মজাপুকুরগুলো পুনঃখননের পাশাপাশি প্রতি গ্রামে সংরক্ষিত খাসপুকুর খনন দরকার।  পুকুরগুলোতে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর বা স্থানীয় সরকারে মাধ্যমে ব্যবস্থা করা দরকার পর্যাপ্ত পন্ড স্যান্ড ফিল্ডারের (পিএসএফ)। পাশাপাশি যেসব উপকূলীয় অঞ্চলে পুকুর খননের মাধ্যমে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়, সেখানে বিশেষ ব্যবস্থায় পাইপ লাইনের মাধ্যমে সুপেয় পানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে ব্যবহার করতে হবে আধুনিক প্রযুক্তি। নিরাপদ পানির প্রাপ্যতা সব প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার। সরকারকে শহর অঞ্চলে নাগরিকদের এই অধিকার সংরক্ষণে ভূমিকা রাখতে দেখি। কিন্তু প্রান্তিক অঞ্চলের ক্ষেত্রে এই প্রচেষ্টা দেখা যায় না, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে একটি। জলবায়ু পরিবর্তন এখানে একের পর এক দুর্যোগ নিয়ে আসে, দুর্যোগের সঙ্গেই আমাদের সবসময় বসবাস। এই দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের সক্ষমতা বিশ^ব্যাপী স্বীকৃতি। তবে এসব দুর্যোগ এখন আর ঘূর্ণিঝড়, খরা ও বন্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নদী ও খালের পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধি উপকূলীয় অঞ্চলের জনগণের জন্য এখন একটি বড় দুর্যোগ। এই দুর্যোগের মুখোমুখি বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ১৯টি জেলার প্রায় ৩ কোটি মানুষ। আমাদের দেশকে অভিযোজনের ক্ষেত্রে চ্যাম্পিয়ন হিসেবে বলা হয়, কিন্তু লবণাক্ততা মোকাবিলায় অভিযোজনের সক্ষমতার সীমাবদ্ধতা আছে। সেটি এই অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর জীবন জীবিকার ক্ষেত্রে যেমন প্রযোজ্য, একই সঙ্গে আরও বেশি প্রযোজ্য এই অঞ্চলের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সুরক্ষার ক্ষেত্রে। বিশেষ করে নারী ও কিশোরীদের বেলায়। বাংলাদেশ সরকার জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বেশ কিছু পরিকল্পনা করেছে, সেই পরিকল্পনার আওতায় উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর সুপেয় পানির সমস্যা সমাধানের অগ্রাধিকার নির্ধারণ এই মুহূর্তের জরুরি পদক্ষেপ হওয়া উচিত। আর এ সমস্যা মোকাবিলায় উপকূলীয় অঞ্চলে সুপেয় পানি ঘাটতির পকেটগুলো চিহ্নিত করা দরকার সবার আগে। এ জন্য প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ নিশ্চিত করা দরকার। সমস্যা মোকাবিলায় শুধু কমিউনিটি ব্যবস্থাপনার ওপর নির্ভর করলে চলবে না, সরকারকে এসব ক্ষেত্রে দায়িত্ব নিতে হবে। শুধু বড় বড় প্রকল্প গ্রহণ করলেই হবে না, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা মোকাবিলায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর জন্য সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা এর মধ্যে অন্যতম।

লেখক: উন্নয়নকর্মী ও কলামিস্ট

psmiraz@yahoo.com