বন্যার ব্যাপকতা: দীর্ঘমেয়াদি ক্ষয়ক্ষতি ও বিপর্যয় মোকাবেলা
বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের পরিণতি ক্রমবর্ধমান হারে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের তীব্রতা এবং ঘনত্ব (Frequency) বৃদ্ধির সাথে সাথে ঝুঁকিপূর্ণ উন্নয়নশীল দেশগুলি দীর্ঘমেয়াদি ক্ষয়ক্ষতি ও বিপর্যয়ের কবলে পড়ছে। ধনী রাষ্ট্রের লাগামহীন কর্পোরেট ভোগবিলাসিতা, নয়া উদারবাদী ব্যবস্থাধীনে প্রাকৃতিক সম্পদের অতিব্যবহার ও অপচয় সহ মানুষের অপরিণামদর্শী কার্যকলাপে প্রশ্নাতীতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে কার্বন নি:সরণের মাত্রা এবং তা জলবায়ু পরিবর্তন ত্বরান্বিত করতে নেতিবাচক ভূমিকা রাখছে। একের পর এক আঘাত হানছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং বিপর্যস্ত করে তুলছে এক একটি জনপদ। ভৌগোলিক অবস্থার কারণে যে সমস্ত দেশ এ ধরনের দুর্যোগ পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে বাংলাদেশ তার অন্যতম। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, খরাসহ বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলাদেশ এখন নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
এ বছরের মে মাসে গোটা দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ ঘূর্ণিঝড় রেমালে আক্রান্ত হয়েছে। রেমালের আঘাত কাটিয়ে না উঠতেই দেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চল পরপর দু’বার বন্যা আক্রান্ত হল। সে বন্যার ক্ষত না শুকাতেই আগস্টে এক আকস্মিক প্রলয়ংকরী বন্যায় আক্রান্ত হল পূর্বাঞ্চলের ১১ টি জেলা। উজান থেকে আসা পানির সাথে অবিরাম বর্ষণ কুশিয়ারা, মনু, খোয়াই, গোমতী ও ফেনীর মতো নদীগুলোর পানি বিপদসীমার ওপরে উঠে গেছে। ফলে মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট, ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, খাগড়াছড়ি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, লক্ষ্মীপুর ও কক্সবাজারের নিম্নাঞ্চলে নজিরবিহীন বন্যা দেখা দিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, সমুদ্রে নদীর পানি নিষ্কাশনের পথ রুদ্ধ হয়ে যাওয়া, অপরিকল্পিত বাঁধ ও উন্নয়ন অবকাঠামো গড়ে উঠায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টির কারণে বন্যা পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হচ্ছে।
অতিভারী বৃষ্টিপাত এবং উজান থেকে আসা পানির কারণে বাংলাদেশের এই অঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতিতে এক জটিল অবস্থা তৈরি করেছে। প্রায় ১২ লক্ষ পরিবার বন্যার পানিতে আটকা পড়েছে এবং সেখানকার ৫৬ লক্ষের অধিক মানুষ চলমান বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এদের মধ্যে ২৫ লক্ষ ৮০ হাজার ৫৭৪ জন নারী, ২৩ লক্ষ ৫৭ হাজার ৩৯৯ জন পুরুষ, ২০ লক্ষ ৫৯ হাজার ৪৮৬ জন শিশু। যার মধ্যে আবার ৬৩ হাজার ১০২ জন প্রতিবন্ধী এবং প্রায় ৪ লক্ষ ৮ হাজার ১০৪ জন বয়স্ক মানুষ।
প্রথমত: বন্যার তীব্রতা এবং দ্বিতীয়ত: আক্রান্ত জেলাগুলোর মধ্যে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত কুমিল্লা, নোয়াখালী ও ফেনী মানুষ দীর্ঘদিন বড় ধরনের কোনো বন্যা পরিস্থিতির মুখোমুখি হননি। ফলে বন্যা মোকাবেলায় তাদের অনভিজ্ঞতা রয়েছে এবং সেধরনের প্রতিরোধ ব্যবস্থাও গড়ে ওঠেনি বা প্রশিক্ষিত মানবসম্পদের অভাব রয়েছে। তার উপর সড়ক ব্যবস্থা বিঘ্নিত হয়েছে, গুদামজাতকরণ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, টেলিযোগাযোগ ব্যাহত। মানুষের দোড়গোড়ায় পৌঁছানোর উপযুক্ত ব্যবস্থা নেই, নেই পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র। অধিকাংশ বাজার অকার্যকর হয়ে পড়েছে এবং সেখানে খাদ্যপণ্যের ব্যাপক ঘাটতি তৈরি হয়েছে।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী ২০ আগস্ট থেকে অধিকাংশ এলাকা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। যার কারণে ২৪ আগস্টের তথ্যানুযায়ী, ক্ষতিগ্রস্ত ৯টি জেলার প্রায় ৯২ লক্ষ ৮০ হাজার মানুষ বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় রয়েছে। ৬,৯৮৬টি মোবাইল ফোন টাওয়ারের মধ্যে ১,৫১০টি টাওয়ার অকার্যকর হয়ে পড়েছে। তারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা প্রিয়জনদের সাথে কোনো ধরনের যোগাযোগ করতে পারছে না। (সূত্র: দৈনিক সমকাল)
৪ হাজার ৬ শত ২৪ কিলোমিটার সড়ক ও রেল যোগাযোগ ব্যবস্থাও অকার্যকর হয়ে পড়ায় মানুষ চলাচল ও পণ্য পরিবহন কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। ভেঙে পড়েছে পুরো সরবরাহ শৃঙ্খল। অধিকাংশ পরিবারের ফসল ও গবাদি পশুর ক্ষতি হয়েছে সীমাহীনভাবে। ১১টি জেলায় প্রায় ৩ লাখ ৭ হাজার হেক্টর আবাদি জমির (ধান ও সবজি ক্ষেত) ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। যার আনুমানিক মূল্য ১৪৫৭ কোটি ২১ লাখ ২ হাজার ৫৬০ টাকা। ফলে ভবিষ্যৎ খাদ্য নিরাপত্তাও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়বে।
পরিসংখ্যান বলছে, গবাদিপশু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ৩১৭ কোটি ৪৯ লক্ষ ৩০ হাজার ৪৮০ টাকার সূত্র: সমকাল। শুধু ফেনী জেলাতেই ৬৪ হাজার গবাদিপশুর মৃত্যু ঘটেছে (দৈনিক সমকাল)। জেলা প্রশাসনের দেওয়া তথ্য অনুসারে শুধু সাত জেলা- ফেনী, কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, মৌলভীবাজারে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার সম্পদের ক্ষতি হিসাব পাওয়া গেছে। অনেক এলাকায় এখনো ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি।
ডিপিএইচই-এর সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী ২৬ হাজার ৫৮৪টি খাবার পানির উৎস এবং ৬২ হাজার ৫২৮ টি টয়লেট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নারী এবং গর্ভবতী মা মারাত্মক অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছে। অধিকন্তু, আশ্রয়কেন্দ্রে অপর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা, যেমন পৃথক স্যানিটেশনের অভাব এবং সেখানে উপচে পড়া ভিড়। যা লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতাসহ জীবিকায় প্রভাব ফেলতে পারে এবং সম্পদে সীমিত প্রবেশাধিকার তাদের আর্থ-সামাজিক চ্যালেঞ্জগুলিকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। একাধিক জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৭ হাজার স্কুল ভবন। এসব স্কুলের প্রায় ১৭ লাখ ৫০ হাজার ছাত্র-ছাত্রীর শিক্ষাজীবন অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেছে।
অর্থাৎ এক মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে গোটা পূর্বাঞ্চলের বন্যাকবলিত মানুষ। বাড়িঘর থেকে আকস্মিক বাস্তুচ্যুত, জীবিকা হারানো এবং সম্প্রদায়ের অবকাঠামো ধ্বংসের ফলে অসহায়ত্ব এবং হতাশা ব্যাপক আকারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফেনীতে, পুরো উপজেলা প্লাবিত হওয়ায় পরিষেবা সহায়তা বন্ধ হয়ে গেছে। এই বিচ্ছিন্নতা একাকিত্ব এবং ভয়ের অনুভূতি বাড়িয়ে তুলতে পারে, কারণ তারা পর্যাপ্ত মানসিক বা মানসিক সমর্থন ছাড়াই দুর্যোগের পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলা করে চলেছে।
১১টি জেলার ৬৮টি উপজেলার ৫০৪টি ইউনিয়ন এই বন্যায় মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হয়েছে। আক্রান্ত এলাকার মানুষ গত এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে খাদ্যসংকটে নিপতিত হয়েছে ও রয়েছে। ইতোমধ্যে ৫৯ জনের মৃত্যুসংবাদ পাওয়া গেছে। বন্যার যে ভয়াবহতা তাতে মৃত্যুর সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাৎক্ষণিক সংকট কেটে গেলেও অপেক্ষা করছে দীর্ঘমেয়াদি সংকট। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলো হয়ত তার মূল্যায়ন করবে এবং সম্ভাব্যক্ষেত্রে পুনর্বাসন প্রচেষ্টাও গ্রহণ করবে। কিন্তু এ মুহূর্তে ক্ষতিগ্রস্ত জনসংখ্যার মানবিক চাহিদা মোকাবেলা করা অত্যন্ত জরুরি। কারণ এই দুর্যোগের মাত্রা জলবায়ু পরিবর্তন এবং চরম আবহাওয়ার ঘটনাগুলির প্রেক্ষাপটে জনগণের দুর্বলতাসমূহকে চিহ্নিত করে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে চলমান এই বন্যা পরিস্থিতিকে একটি জটিল মানবিক সংকটের জন্ম দিয়েছে, যা পরিবেশগত কারণ দ্বারা সৃষ্ট এবং অপরিকল্পিত উন্নয়ন ও অবকাঠামোগত দুর্বলতার কারণে বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীকে সহায়তা করতে এবং এই দুর্যোগের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব মোকাবেলায় অবিলম্বে টেকসই প্রচেষ্টা গ্রহণ অপরিহার্য।
আশার কথা হল, ইতোমধ্যে সামাজিক সংগঠন, রাজনৈতিক দল, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ বিপুল ছাত্র-জনতা দল-মত নির্বিশেষে ত্রাণ কার্যক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কিন্তু বন্যার যে ব্যাপ্তি তাতে বিপর্যস্ত মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারছে না উদ্ধারকারী দল ও ত্রাণ সহায়তা প্রদানকারীরা। সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর পাশাপাশি বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠনের প্রশিক্ষিত দল কাজ করলেও, এরকম প্রশিক্ষিত ও দক্ষ উদ্ধারকারী দলের ঘাটতি বিশেষভাবে চোখে পড়েছে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় উদ্ধার কার্যক্রম আরো বিস্তৃত করা এবং দুর্গম এলাকায় ত্রাণ পৌঁছানোর ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। বন্যার যে ব্যাপকতা লাভ করেছে তা মোকাবেলায় প্রয়োজন হবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও তার যুগোপযোগী বাস্তবায়ন। আভ্যন্তরীণ সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পক্ষ ও চুক্তি সমূহের বাস্তবায়ন জরুরি। প্রতিবেশী দেশের সাথে যৌথ নদীসমূহের যথাযথ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা। আন্তর্জাতিকভাবে, প্যারিস জলবায়ু চুক্তি অনুযায়ী জলবায়ু তহবিল এবং লস এন্ড ড্যামেজ তহবিল কার্যকরভাবে গঠন ও তার যথাযথ প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মত দেশগুলোতে অগ্রণী ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। তবে, এ ধরনের মহাবিপর্যয় মোকাবেলায় জাতীয়ভাবে সুষ্ঠু ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ, বাস্তবায়নে বিচক্ষণতা ও আন্তরিকতার কোন বিকল্প নেই। সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহের পাশাপাশি সর্বস্তরের মানুষকেও সক্ষম করে গড়ে তুলতে হবে।
লেখক পরিচিতি:
ফারাহ্ কবির, কান্ট্রি ডিরেক্টর
একশনএইড বাংলাদেশ